(নিউ ইয়র্ক) - বাংলাদেশ সরকার প্রায় ২০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, জীবন-জীবিকা বা সুরক্ষা ছাড়াই প্রত্যন্ত দ্বীপে স্থানান্তরিত করেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বা এর বাইরেও ভাসান চরে সুরক্ষা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং আবাসস্থলতার স্বাধীন মূল্যায়নের জন্য জাতিসংঘ এবং দাতা সরকারগুলোর জরুরিভাবে আহ্বান জানানো উচিত।
“'সমুদ্রের মধ্যবর্তী একটি দ্বীপে জেলখানা': বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসান চরে স্থানান্তর,” নামে ৫২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে যে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনেক শরণার্থীকে সম্পূর্ণভাবে, অবহিতকরণ সম্মতি ছাড়াই দ্বীপে স্থানান্তরিত করেছে এবং মূল ভূখণ্ডে তাদের ফিরে আসতে বাধা দিয়েছে। যদিও সরকার বলছে যে তারা কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরগুলিতে উপচে পড়া ভিড় কমিয়ে আনতে কমপক্ষে ১০০,০০০ মানুষকে বঙ্গোপসাগরের পলি দ্বীপে সরিয়ে নিতে চায়, মানবিক সহায়তাকারী বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে গুরুতর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষার জন্য অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। দ্বীপের শরণার্থীরা স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার অপর্যাপ্ততা, চলাচলের দুঃসহ বিধিনিষেধ, খাদ্য সংকট, জীবন-জীবিকার সুযোগের অভাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহারের কথা জানিয়েছেন।
"বাংলাদেশ সরকার দশ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ মোকাবেলা করতে অসুবিধা বোধ করছে, কিন্তু প্রত্যন্ত দ্বীপে মানুষকে নিয়ে যেতে বাধ্য করা শুধু নতুন সমস্যা তৈরি করছে," শরণার্থী ও অভিবাসী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন। "আন্তর্জাতিক দাতাদের রোহিঙ্গাদের সহায়তা করা উচিত, তবে এটাও জোর দেয়া উচিত যে শরনার্থীরা যারা মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসতে চায় বাংলাদেশের তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা, অথবা বিশেষজ্ঞরা যদি বলেন দ্বীপের পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক বা টেকসই না।"
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২০ সালের মে মাস থেকে ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে ১৬৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, যাদের মধ্যে ভাসান চরের ১১৭ জন এবং কক্সবাজারের ৫০ জন, যাদের মধ্যে ৩০ জনকে পরে ভাসান চরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতির মূল দায়িত্ব মায়ানমারের ওপর বর্তায়। ২৫শে আগস্ট, ২০১৭-তে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে জাতিগত নির্মূলের নৃশংস অভিযান শুরু করেছিল যা ৭৪০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল, যেখানে দেশটি ইতিমধ্যে আনুমানিক ৩০০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ আগের নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল। মায়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতনমূলক ঘটনার অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার শর্ত তৈরি করতে অস্বীকার করেছে।
বাংলাদেশ প্রশংসনীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমানা খুলে দেওয়ার পরে, কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পের পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্বপূর্ণ করে তুলেনি, বরং ভাসান চরে স্থানান্তরিত করার চাপ বাড়িয়ে তুলছে। কর্তৃপক্ষ শরণার্থী ক্যাম্প গুলিতে প্রায় এক বছর ধরে ইন্টারনেটের সুযোগ বন্ধ করে রেখেছিল, শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা অননুমোদন করেছিল এবং কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করে চলাচল এবং জরুরি পরিষেবাগুলির প্রবেশাধিকারকে বাধা দেয়া হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনীগুলি নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের মুখোমুখি হয়।
২০২০ সালের মে মাসে, বাংলাদেশ সমুদ্রপথে উদ্ধারকৃত ৩০০ এরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভাসান চরে নিয়ে এসেছিল। যদিও সরকার প্রাথমিকভাবে বলেছিল যে তারা ক্যাম্প গুলিতে কোভিড -১৯ এর বিস্তার রোধ করতে তাদেরকে দ্বীপে কোয়ারাইন্টাইন করে রাখা হচ্ছে, তবে এখনও তারা তাদের পরিবারের সাথে পুনরায় একত্রিত হতে পারেনি। ডিসেম্বরে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ হাজার হাজার শরণার্থীদের ক্যাম্প গুলি থেকে দ্বীপে স্থানান্তরিত করা শুরু করে, এবং এই পুনরায় প্রতিশ্রুতি করে যে দ্বীপে সুরক্ষার চাহিদা, নিরাপত্তা এবং আবাসস্থল সম্পর্কে একটি স্বাধীন প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন করার অনুমতি দিবে।
এখন, জাতিসংঘের ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল এই দ্বীপটি ১৭ থেকে ২০ মার্চ দেখার জন্য নেওয়ার পরে, কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘকে মানবিক সহায়তা প্রদান শুরু করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। শরনার্থীরা বলেছে যে জাতিসংঘ সফরের সময় তাদের কেবল বাংলাদেশ সরকারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কথা বলতে দেওয়া হয়েছিল, এবং তাদের বাধ্য করা হয়েছিল এই ভাবে কথা বলতে যেন দ্বীপে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
২০২১ সালের ৩১শে মে, হাজার হাজার শরণার্থী জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল যারা ভাসান চর পরিদর্শন করছিলেন তাদের সাথে দেখা করার জন্য জড়ো হয়েছিল এবং শর্তগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, অনেকে বলেছিল যে তারা এই দ্বীপে থাকতে চায় না। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এর আগেই রোহিঙ্গাদের অভিযোগ না করবার জন্যে সতর্ক করেছিল, কিছু শরণার্থী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শরণার্থীরা এই নির্দেশনা অগ্রাহ্য করার পরে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল এবং নারী ও শিশু সহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা আহত হয়েছিল।
ভাসান চরে ভবিষ্যতে যে কোনও মানবিক সহায়তার অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা শুরু করা উচিত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে। এই দ্বীপে ইতিমধ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুস্থতা, নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা উন্নয়নে জাতিসংঘের তাদের সফর পরবর্তী সুপারিশগুলি নিয়েও কর্তৃপক্ষকে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশ সরকার একটি চিঠিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছে যে, এটি "ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য উপযুক্ত স্যানিটেশন এবং চিকিৎসা সুবিধার পাশাপাশি পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করেছে" এবং সকল স্থানান্তরিতকরণ অবহিত সম্মতির ভিত্তিতে করা হয়েছিল। তবে শরণার্থীরা এই দাবিগুলি ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ৫৩ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি বলেছিলেন যে ক্যাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা ক্যাম্প প্রশাসক তাকে হুমকি দেওয়ার পরে তিনি স্থানান্তরিত হওয়া এড়াতে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন: “তিনি বলেছিলেন, যদি আমি মারাও গিয়ে থাকি, তারা আমার মরদেহ সেখানে নিয়ে যাবে। আমি সেই দ্বীপে যেতে চাই না।“ অন্যরা বলেছেন যে তারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছিলেন।
শরনার্থীরা দ্বীপে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার বিষয়েও বর্ণনা করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৪ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছিল যারা বলেছিল যে তারা হাঁপানি (অ্যাজমা), ব্যথা, জ্বর, বাত, ডায়াবেটিস, আলসার এবং ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন অবস্থার জন্য চিকিৎসা চেয়েছিল তবে বেশিরভাগকেই প্যারাসিটামল (অ্যাসিটামিনোফেন) ট্যাবলেট দেয়া হয়েছিল এবং পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৪ জনের মধ্যে চারজন মারা গিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস করেন যে অপর্যাপ্ত জরুরি স্বাস্থ্য সেবার ফলাফল স্বরূপ এমনটি হয়েছে।
দ্বীপে কোনও জরুরি চিকিৎসা সেবা নেই। যদি কোনও চিকিৎসক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন এবং দ্বীপ কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুমোদিত হয়ে থাকে, তবে শরণার্থীদের জরুরি সেবার জন্য নিকটস্থ মূল ভূখণ্ডের হাসপাতালে তিন ঘন্টা নৌকায় করে এবং তারপরে দুই ঘন্টার রাস্তায় যেতে হবে। এর মধ্যে রয়েছেন গর্ভবতী মহিলারা যাদের জীবন রক্ষার চিকিৎসার জন্য হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সন্তান প্রসবের সময় স্ত্রীকে হারানো একজন শরণার্থী বলেছিলেন, জটিলতার পরে যখন ডাক্তাররা তাকে মূল ভূখণ্ডের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন, অনুমতি পেতে দুই ঘন্টা সময় লেগেছিল, ততক্ষণে তিনি মারা গিয়েছিলেন।
শরণার্থীরা বলেছিল যে দ্বীপে তাদের বাচ্চাদের জন্য শিক্ষক, স্কুল এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত শিক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে একজন সহায়তা কর্মী জানিয়েছেন যে আনুমানিক ৮,৪৯৫ জন শিশু ভাসান চরে রয়েছে, "সর্বোপরি চারটি এনজিও বাচ্চাদের শিক্ষা প্রদান করছে যা ১,৫০০ এর বেশি না।"
মিজান (৩৫) বলেছিলেন যে তার ৭ এবং ৯ বছরের কন্যারা যে শিক্ষা গ্রহণ করছিল তা ক্যাম্পের তুলনায় আসলেই কম ছিল: “আমরা এখানে ছয় মাস ধরে আছি এখন এবং আমার মেয়েরা তাদের সকল জিনিসপত্র, ব্যাগ এবং বই নিয়ে এসেছিল, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য, তবে এখানে এমনকি কোন শিক্ষা কেন্দ্রও নেই।”
জুনে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে দ্বীপটি প্রচন্ড বাতাস এবং বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্বীপের আশেপাশের বাঁধগুলি সম্ভবত তিন নম্বর সংকেত বা শ্রেনীর ঝড় বা আরও খারাপ ঝড়কে মোকাবেলা করতে অপর্যাপ্ত। যদিও সরকার বলেছে যে সেখানে পর্যাপ্ত ঝড়ের আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, তবুও আশঙ্কা রয়েছে যে শরণার্থী, বাংলাদেশী নিরাপত্তা কর্মী এবং মানবিক সহায়তা কর্মীরা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সামুদ্রিক বা বিমান পরিবহনের নিষেধাজ্ঞার কারনে শেষ পর্যন্ত সীমিত সরবরাহ নিয়ে এই দ্বীপে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় কর্তৃপক্ষ ভাসান চরে সাম্প্রতিক একটি স্থানান্তর বন্ধ করে দেয়।
“এমন দুর্গম, নিচু জায়গায় অবস্থিত দ্বীপে যেখানে ঘূর্ণিঝড় প্রায়শই দেখা যায় সেখানে অনিচ্ছুক শরণার্থীদের রেখে দেয়া একটি খারাপ ধারণা,” ফ্রেলিক বলেছেন। "রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যারা এত বেশি হারিয়েছেন এবং কষ্ট সহ্য করেছেন, তাদের নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্যের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করা উচিত এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত তাদের অবহিতকরন, জীবনযাত্রার বিষয়ে স্বেচ্ছায় তাদের পছন্দগুলির অনুমতি দেওয়া উচিত।"
শরনার্থীদের বর্ণনা
ভাসান চরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দ্বারা শাস্তি প্রদানের উচ্চ ঝুঁকির কারণে উল্লেখিত সকল শরণার্থীকে ছদ্মনাম দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।
সম্মতি অবহিতকরন, চলাচলের স্বাধীনতা, জীবন-জীবিকা
তসলিমা, যিনি কক্সবাজারে বসবাস করছেন কিন্তু তার ১৩ বছর বয়সী ছেলে ২০২০ সালের মে মাসে সমুদ্র থেকে উদ্ধার হবার পর থেকে ভাসান চরে অবস্থান করছে, তিনি বলেছেন:
আমার ছেলে এক বছরের জন্য ভাসান চরে আটক রয়েছে। সে প্রাপ্ত বয়স্কও নয়। আমার ছেলে তাকে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর জন্যে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের বার বার বলে যাচ্ছিল, তবে প্রতিবারই তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। আমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে এখানকার ক্যাম্প সিআইসি (CiC) [ক্যাম্প-ইন-চার্জ, একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা প্রশাসক] এর সাথেও যোগাযোগ করেছি তবে তারা বলেছে যে আমার ছেলের সাথে দেখা করার একমাত্র পথ হতে পারে যদি আমি ভাসান চরে স্থানান্তরিত হই। তবে আমার ছেলে আমাকে সেখানে যেতে বারণ করেছে কারণ এটি একটি কারাগারের মতো।
ইউসুফ আলী (৪৩), যিনি কক্সবাজারে থাকেন এবং যার দুই মেয়েকে ভাসান চরে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তিনি বলেছিলেন, “সিআইসি আমাদের বলেছিল যে আমাদের মেয়েদের এখানে আর ফিরিয়ে আনা হবে না। তারা বলেছিল যে ‘আপনার কাছে এখনও সেখানে [ভাসান চরে] যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আছে, অন্যথায় আপনার বাচ্চাদের কথা ভুলে যান।"
ভাসান চরের এক শরণার্থী আনজুল (৪০) বলেছেন:
তারা আমাদের ভাল খাবার এবং প্রচুর জীবন জীবিকার সুযোগের, যেমন পশুপাখি লালন পালন বা মাছ ধরা, এসবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা যখন বাসে উঠলাম তখন তারা আমাদের প্রত্যেককে ৫,০০০ টাকা [ইউএস ডলার $৬০] দিয়েছিল এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে প্রতিমাসে আমাদের ৫,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। তবে এখানে আসার পরে, এ ধরণের কোনও সুযোগ নেই এবং এখন আমরা খাদ্যের অভাবের সম্মুখীন হয়েছি।
তিনি বলেছিলেন যে যখন শরণার্থীরা ভাসান চরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল, কিছু কর্মকর্তা তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তারা দ্বীপ ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে, তবে তেমনটা হয়ে ওঠেনি। “আমার বয়স্ক মা-বাবা ক্যাম্পে রয়েছেন। আমি অন্তত তাদের জানাজায় অংশ নিতে চাই, ”তিনি বলেছিলেন। "তবে যতক্ষণ না আমি এখানে বন্দী আছি ততক্ষণ তা সম্ভব হবে না।"
অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা
এমদাদের ১৮ মাস বয়সী কন্যা ভাসান চরে পৌঁছানোর এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। তিনি বলেছিলেন যে কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকাকালীন শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, তবে সেখানে তারা মেডিসিন্স সানস ফ্রন্টিয়ার্স (Medecins Sans Frontieres) হাসপাতালে অক্সিজেন পেতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে যখন তারা ভাসান চরে পৌঁছায় এবং তার মেয়ের আবার শ্বাস নিতে সমস্যা হতে শুরু হয়, ডাক্তাররা তার উদ্বেগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন:
১১ মার্চ, [আমার মেয়ে]’র আবারও শ্বাসকষ্টের সমস্যা হচ্ছিল এবং আমি তাকে এখানকার সরকারী স্বাস্থ্য সেবা হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যাই। ডাক্তার একটি কাশির সিরাপের প্রেসক্রাইব করে আমাদের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তার কোনও উন্নতি হয়নি। পরের দিন সকালে, আমি আবার তাকে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং অনুরোধ করেছিলাম যেনো ডাক্তার তাকে অক্সিজেন সহায়তা দেন যেহেতু আমি তার অফিসে সিলিন্ডারটি দেখতে পাচ্ছিলাম, এবং আমার মেয়ে সেটি ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় এই নিরাময়টি গ্রহণ করেছিল। আমি তাকে এমএসএফ ডাক্তাররা যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন তা দেখানোর চেষ্টা করেছি, তবে সে দেখতে রাজি হয়নি। তিনি আমাকে বললেন, “আপনার কি মনে হয় আমরা আপনার মেয়েকে সহায়তা করার জন্য এখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিয়ে বসে আছি? আমি তাকে আরও ঔষুধ দিচ্ছি, সে সুস্থ হয়ে উঠবে,” এবং আমাদেরকে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ছেড়ে যেতে বলেছিলেন। আমি আমার আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে আসার পরপরই তার অবস্থার অবনতি ঘটে। দুই ঘন্টা পরে আমার মেয়েটি মারা যায়।
এমদাদ বলেছিলেন যে তার মেয়ে মারা যাওয়ার পরে কর্তৃপক্ষ তার আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছিল এবং এমএসএফের নথিপত্র সহ তার চিকিৎসার সমস্ত নথিপত্র নিয়ে গেছে এবং তারা মৃত্যুর সনদপত্র প্রদান করতে অস্বীকার করেছিল।
বিবির স্বামী, ৫৮, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সহায়তা এবং হাঁপানির ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হবার পরে কিছু জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন:
আমি আমার স্বামীকে তিন থেকে চার বার এখানকার স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা সঠিক চিকিৎসা বা ঔষুধ দিতে পারেনি। শেষ বার যখন আমি তাকে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম যখন তার পরিস্থিতি আবারও খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তখন আমি চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্মীদের অনুরোধ করেছিলাম দ্বীপের বাইরে আমাদের নিয়ে যেতে অথবা আমাদের কক্সবাজারে ফিরিয়ে নিয়ে এমএসএফ হাসপাতাল বা তুর্কি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য, কিন্তু তারা সেই অনুমতি দেয়নি। এর পরিবর্তে, তারা আমার স্বামীকে স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল এবং বলেছিল সে ঘরে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠবে। পরদিন সকালে তার মৃত্যু হয়।
৬২ বছর বয়সী জুবায়ের, যিনি ফেব্রুয়ারিতে ভাসান চরে পৌঁছায়, পেটের আলসার, হজমে জটিলতা এবং তীব্র পেট ফুলে যাওয়া নিয়ে ভুগছিলেন। “আমি যখন [কক্সবাজারে] ক্যাম্পে ছিলাম তখন সহায়তা কর্মীরা আমাকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য আমার আশ্রয়কেন্দ্রে আসতেন কারণ আমি বয়স্ক ব্যক্তি এবং আমি নিজে থেকে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে যেতে পারি না। কখনও কখনও এই স্বেচ্ছাসেবীরা আমাকে এমএসএফ (MSF) হাসপাতাল বা আইওএম (IOM) হাসপাতালে নিয়ে যেতে সহায়তা করতেন যেখানে আমি ওষুধ বা চিকিৎসা পেতে পারতাম যা বেশিরভাগ সময়ই আমাকে সাহায্য করতো।" কিন্তু জুবায়ের যখন ভাসান চরের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান, তাদের প্রস্তাবিত ঔষুধ তাকে সুস্থ করেনি। স্বাস্থ্য কর্মীরা তাকে মূল ভূখণ্ডের একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত হবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তবে সেটির জন্য তাকে অর্থ দিতে হবে। তিনি বলেছিলেনঃ
পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে এখানে পৌঁছানোর প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন পরে আমি এখানকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। এখানকার চিকিৎসকরা কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। যখন কোনো রকম অগ্রগতি হয়নি এবং আমি আর কোনও ধরনের নড়াচড়া করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলাম, পরিবারের সদস্যরা এবং প্রতিবেশীরা তখন আমাকে দুইবার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে সহায়তা করেছিলেন। শেষবার যখন আমি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম, তারা আমাকে নোয়াখালীর [মূল ভূখণ্ডে] হাসপাতালে যাওয়ার জন্য টাকা নিয়ে আসতে বলেছিল কারণ আমার পরিস্থিতির খুব খারাপভাবে অবনতি হয়েছিল। আমার নিজস্ব কোন অর্থ নেই এবং আমি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে লজ্জা বোধ করি। তার থেকে বরং আমার পরিবার নিয়ে এখানেই মারা যাওয়াই ভাল।