(নিউ ইয়র্ক) - কোভিড -১৯ সম্পর্কে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করায়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ "ফেসবুকে গুজব এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার " অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তারসহ আরোও সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ এ কথা বলেছে। কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে হেফাজতে থাকা এই চারজনকে মুক্তিসহ সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করা উচিত যা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে, এবং একই সাথে কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) বাতিল করা উচিত।
রমনা থানার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (FIR) অনুসারে, ১১জনকে “জেনে শুনে জাতির জনক ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং করোনা ভাইরাস মহামারী নিয়ে নেতিবাচকভাবে জাতির ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে প্রভাবিত করায়”- এবং যার ফলে “আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হওয়ায়,” ব্যাপকভাবে অপব্যবহৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
"এটি কেবল একটি অনিরাপদ ও স্বৈরাচারী সরকার যা কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য মহামারীকে ব্যবহার করে," বলছিলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ব্র্যাড অ্যাডামস। "ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে এমন মামলা দায়েরের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনাটিতে নজর দেয়া উচিত এবং কোভিড -১৯-এর বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপগুলোতে কোনও ফাঁক আছে কিনা সেগুলি সমাধান করার চেষ্টা করা উচিত।"
কার্টুনিস্ট আহম্মেদ কবির কিশোর; লেখক ও মানবাধিকার কর্মী মোস্তাক আহম্মেদ; মানবাধিকার কর্মী দিদারুল ভূঁইয়া; এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডিরেক্টর মিনহাজ মান্নান ইমন হেফাজতে রয়েছেন। অন্যান্য আরো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা হলেন, সাংবাদিক তাসনিম খলিল এবং শাহেদ আলম; ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন এবং সায়ের জুলকারনাইন, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার এবং স্বপন ওয়াহিদ- এদের সকলেই বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কর্তৃপক্ষ আরও ৫ অথবা ৬ জন “অজ্ঞাত” ব্যক্তিকেও অভিযুক্ত করেছে।
করোন ভাইরাস প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের চলমান ধরপাকড়ের (crackdown) মধ্যেই এই মামলাগুলো করা হয়েছে। সরকার ৭ই মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যেখানে সকল সরকারি কর্মকর্তাদের যে কোন পোস্ট করা, “লাইক করা (liking),” শেয়ার করা (sharing), অথবা মন্তব্য করাকে নিষিদ্ধ করে যা “রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে" অথবা সরকারের "গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের" সুনাম ক্ষুন্ন করতে পারে, এই আদেশের লঙ্ঘন হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ার জারি করে। কর্তৃপক্ষ "গুজব" ছড়িয়ে দিতে পারে এমন যে কোনও ব্যক্তির ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে এবং গনমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ (media censorship) জোরদার করে তুলেছে। দেশের প্রথম সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কোভিড -১৯ সংক্রান্ত “গুজব” চিহ্নিত করতে সম্প্রতি একটি “সাইবার ভেরিফিকেশন সেল” (cyber verification cell) গঠন করেছে। পুলিশ বলেছে র্যাব-৩ সাইবার টীম “আই অ্যাম বাংলাদেশি” (I am Bangladeshi) নামে একটি ফেসবুক পেইজ খুঁজে পেয়েছে, যা এই অভিযোগগুলোর মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তারা কিশোরের বাসায় অভিযান চালিয়ে তার ফোন এবং কম্পিউটার জব্দ করে এবং "ক্ষমতাসীন-দলের নেতাদের নিয়ে কার্টুন এঁকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য গুজব ছড়াচ্ছেন" বলে অভিযোগের “সত্যতা” খুঁজে পায়। কিশোর সম্প্রতি ফেসবুকে ‘লাইফ ইন দ্য টাইম অফ করোনা’ (Life in the Time of Corona) শিরোনামে ধারাবাহিক কার্টুন পোস্ট করছিলেন, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা এবং সরকারের কোভিড -১৯ পদক্ষেপগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আহমেদ সম্প্রতি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের (Personal Protective Equipment) ঘাটতির সমালোচনা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। মানবাধিকারকর্মী সংগঠন রাষ্ট্রচিন্তার মূল সংগঠক ভুঁইয়া সরকারের কোভিড -১৯ নীতিগুলি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন স্পষ্টভাষী (vocal) সমালোচক এবং সরকারী পদক্ষেপগুলোতে দূর্নীতি এবং ব্যর্থতা পর্যবেক্ষণ করা সম্প্রতি গঠিত একটি কমিটির সাথে জড়িত ছিলেন। ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল একটি উদ্বোধনী সংবাদ সম্মেলনে, ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দে অসঙ্গতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করে কমিটি বলেছিল যে দরিদ্রদের পিছনে ফেলে রাখা হচ্ছে।
পুলিশ এজাহারে দাবী করা হয়েছে খলিল সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর বিষয়বস্তু প্ররোচিত করেছেন, তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ করা হয়, তিনি “ফেসবুকে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ এবং করোনা ভাইরাস মহামারী নিয়ে অসত্য খবর (Fake News) এবং আপত্তিজনক মন্তব্য ছড়িয়েছেন,” এবং তিনি “দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে” “নিরাপত্তা সংস্থা এবং সেনাবাহিনী” নিয়ে লেখালেখি করেছেন।
খলিল অনলাইন ভিত্তিক নেত্র নিউজের সম্পাদক, মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত প্রতিবেদন করার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের ভেতরে নেত্র নিউজ এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নেত্র নিউজ সম্প্রতিকালে জাতিসংঘের ফাঁস হয়ে যাওয়া আন্তঃসংযোগকারী একটি স্মারকলিপি প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যদি তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তাহলে বাংলাদেশে ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখের মত মানুষ মারা যেতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA)- এর ধারা ২১, ২৫, ৩১ এবং ৩৫ এর অধীনে ১১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধারা ২১ স্বাধীনতা যুদ্ধ, “জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত, অথবা জাতীয় পতাকা এর বিরুদ্ধে” “যেকোনো ধরণের প্রপাগান্ডা (propaganda) অথবা প্রচারণা” কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। ধারা ২৫ অনুযায়ী "আপত্তিকর বা ভীতি প্ররোচনা" মূলক কোনো প্রকাশিত তথ্য বা যে কোনো বিষয়বস্তু যা "জাতির ভাবমূর্তি নষ্ট করে" তা অপরাধ বলে গণ্য হবে যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড। ধারা ৩১ অনুযায়ী, প্রকাশিত তথ্য যা "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ব্যাহত করে" বা "আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার জন্য হুমকি" বলে বিবেচিত হবে তার জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকারের হাই কমিশনার, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং আরো অনেকেই আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের কারণে বারবারই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমালোচনা করেছে। বাংলাদেশ নাগরিক সমাজের ৩১১ জন সদস্য বাক-স্বাধীনতা বহাল রাখা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবীতে একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করে।
র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আহমেদ এবং ভূঁইয়াকে জোড়পূর্বক গুম করার এবং পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পুর্বে তাদের গোপনে আটক করে রাখার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তারের প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয় ৫ই মে সকালে এবং ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয় ৬ই মে। তবে, তাদের পরিবার জানায় যে সাদা পোশাক পরিহিত কিছু ব্যাক্তি নিজেদের র্যাব-৩ এর সদস্য বলে দাবি করে তাদেরকে আগেই তুলে নিয়ে যায়।
ভূঁইয়ার ভগ্নিপতি গনমাধ্যমকে জানায় যে, ৫ই মে সন্ধায় তাদের পরিবার এবং কিছু সহকর্মী ঢাকার বাড্ডায় ভূঁইয়ার বাসায় ইফতার করছিলেন, তখন ৭-৮ জন ব্যাক্তি দরজায় কড়া নাড়ে এবং নিজেদের র্যাব-৩ বলে পরিচয় দেয়। তারা ভূঁইয়ার ল্যাপটপ, দুইটি কম্পিউটার, এবং মোবাইল ফোন সংগ্রহ করে এবং একটি কালো মাইক্রোবাসে করে তাকে নিয়ে যায়। পরে তার খোঁজ জানতে চাওয়া হলে র্যাব কর্মকর্তারা তার পরিবারকে জানায় যে ভূঁইয়া তাদের হেফাজতে ছিলো না।
তার স্ত্রী লিপা আখতারের ভাষ্য অনুযায়ী, ৪ই মে র্যাব-৩ হিসেবে দাবি করে ৪ জন ব্যাক্তি আহমেদকে ঢাকার লালমাটিয়ায় তার নিজ বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। তবে, আহমেদ তাদের হেফাজতে আছে বলে অস্বীকার করেছে র্যাব কর্মকর্তাগণ। আখতার জানান প্রায় ২৪ ঘন্টা পর “রমনা থানা থেকে কল আসে এই বলে যে আমার স্বামী তাদের সাথে আছে এবং আমি যেন থানায় যাই এবং তাকে খাবার দেই।“
হত্যা, নির্যাতন ও জোড়পূর্বক গুমসহ গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে অভিযুক্ত রয়েছে র্যাব। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাবকে ভেঙে ফেলা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মানকারী একটি বাহিনীতে প্রতিস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছে।
এই গ্রেপ্তারগুলো ৯ই এপ্রিলে সরকারের দেয়া নির্দেশনার পরপরই হল যেখানে গনমাধ্যমকে জরুরি সেবার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে যেটা লকডাউন নিষেধাজ্ঞার বাহিরে থাকতে পারত। কোভিড-১৯ এর প্রতি সরকারের পদক্ষেপ গুলো নিয়ে সমালোচনা করায় বাংলাদেশে বেনার নিউজ এবং অন্যান্য ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ (block) করা হয়েছে। সরকার সরকারি হাসপাতালের নার্সদের পূর্ব অনুমতি ব্যাতিত গনমাধ্যমের সামনে কথা বলা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছে এবং ব্যাক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম এবং সম্পদসমূহের অপর্যাপ্ততার বিষয়ে কথা বললে ডাক্তারদেকে ওপর ধরপাকড় করছে। শত শত ডাক্তাররা এই ভাইরাসে পজিটিভ (positive) হিসেবে আক্রান্ত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে, সকল ধরণের তথ্য অনুসন্ধান, প্রাপ্তি এবং প্রদানের অধিকার সহ বাকস্বাধীনতার অধিকার রক্ষায় সরকারগুলির একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসবের মধ্যে সরকার, সুপরিচিত ব্যাক্তিবর্গ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করার স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত। জনস্বাস্থ্যের কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর অনুমতিযোগ্য বিধিনিষেধগুলি এই অধিকারগুলোকে বিপন্নতায় ফেলতে পারে না।
“বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটি উপলব্ধি করা জরুরি যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে বাক-স্বাধীনতা একটি মুখ্য বিষয়,” বলেছেন অ্যাডামস। “সরকারের উচিত উদ্বেগ প্রকাশের কারণে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, ডাক্তার এবং নার্সদের ওপর হয়রানি বন্ধ করা এবং এগুলোর পরিবর্তে সাহায্য-সহায়তা, স্বচ্ছতা এবং সম্পদ্গুলোর ওপর জরুরি ভিত্তিতে নজর দেয়া যেগুলো নিয়ে তারাই প্রথমে উদ্বেগ জানিয়েছে।“