- অনেক ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানিগুলো জেনেশুনে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া তাদের জাহাজ গুলোকে বাংলাদেশের বিপজ্জনক ও দূষণকারী ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপের জন্য পাঠাচ্ছে।
- বাংলাদেশের ইয়ার্ডে জাহাজ স্ক্র্যাপিং কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি জীবন ও পরিবেশের খরচের বিনিময়ে মুনাফার জন্য আন্তর্জাতিক নিয়মের ফাঁকফোকর গুলো ব্যবহার করে থাকে।
- শিপিং কোম্পানিগুলিকে একটি মানদণ্ডে স্থিতিশীল প্ল্যাটফর্ম সুবিধা তৈরিতে বিনিয়োগ করা উচিত যা কর্মীদের অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করে এবং বর্জ্য নিষ্পত্তি পরিচালনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত ত্রুটিগুলি বন্ধ করতে তার নিয়মগুলি সংশোধন করা।
(ঢাকা)– অনেক ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানি জেনে শুনে তাদের মেয়াদ উত্তীর্নর জাহাজগুলিকে বাংলাদেশে বিপজ্জনক এবং দূষণকারী ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপের জন্য পাঠাচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম আজ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে।
৯০-পৃষ্ঠার প্রতিবেদন, "ট্রেডিং লাইভস ফর প্রফিট (মুনাফার জন্য জীবন বেচা কেনাঃ কিভাবে জাহাজ শিল্প বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে বিষাক্ত জাহাজ ভাঙার জন্য প্রবিধান লঙ্ঘন করে -তে দেখায় যে বাংলাদেশী জাহাজ ভাঙ্গা ইয়ার্ডগুলি প্রায়শই নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য শর্ট কাট পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে, এবং বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি সমুদ্র সৈকতে এবং আশেপাশের পরিবেশে ফেলে দেয় এবং শ্রমিকদের জীবন যাপনের মজুরি, বিশ্রাম বা ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে। প্রতিবেদনে জাহাজের মালিকদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক প্রকাশ করা হয়েছে যেটি বাংলাদেশের মতো যেখানে পর্যাপ্ত পরিবেশগত বা শ্রম সুরক্ষা নেই সেখানে জাহাজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এমন আন্তর্জাতিক বিধিবিধানকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে।
“বাংলাদেশের বিপজ্জনক এবং দূষণকারী ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি জীবন ও পরিবেশের মূল্যের বিনিময়ে মুনাফা অর্জন করছে,” হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র এশিয়া গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেছেন। "শিপিং কোম্পানিগুলিকে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের ফাঁক ফোকরগুলো ব্যবহার বন্ধ করা উচিত এবং নিরাপদে এবং দায়িত্বশীলভাবে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়া উচিত।"
জাহাজের নিরাপদ এবং পরিবেশগত ভাবে উপযুক্ত রিসাইক্লিংয়ের জন্য হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনটিকে, যা ২০২৫ সালে কার্যকর হবে, একটি নিরাপদ এবং টেকসই জাহাজ পুনর্ব্যবহার যোগ্য শিল্প নিশ্চিত করতে শক্তিশালী করা উচিত, সংস্থা গুলি বলেছে। দেশগুলোর উচিত জাহাজের নিষ্পত্তি নিয়ন্ত্রণকারী বিদ্যমান আন্তর্জাতিক শ্রম এবং পরিবেশগত আইন মেনে চলা, যার মধ্যে রয়েছে বিপজ্জনক বর্জ্য এবং তাদের নিষ্পত্তির আন্তঃসীমান্ত গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের বাসেল কনভেনশন।
প্রতিবেদনে ৪৫ জন জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক এবং শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজন এবং ১০ জন ডাক্তার এবং জাহাজ রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহার এবং বাংলাদেশের পরিবেশ ও শ্রম আইনের বিশেষজ্ঞদের সাথে সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি পাবলিক শিপিং ডেটাবেজ, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন এবং ওয়েবসাইট, বাংলাদেশ মেরিটাইম আমদানি রেকর্ড এবং ফাঁস করা আমদানি সার্টিফিকেট রয়েছে। শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, শিপিং কোম্পানি, পতাকা রেজিস্ট্রি এবং নগদ ক্রেতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এবং চারটি বাংলাদেশী সরকারী সংস্থা সহ আমাদের অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়া চেয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২১টি সংস্থাকে চিঠি লিখেছে।
জাহাজ ভাঙ্গা বা স্ক্র্যাপিংয়ের জন্য বাংলাদেশ একটি শীর্ষ গন্তব্য। ২০২০ সাল থেকে, আনুমানিক ২০,০০০ বাংলাদেশি শ্রমিক ৫২০টিরও বেশি জাহাজ কেটে ফেলেছে, যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি টন ওজনের।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জাহাজ ভাঙ্গাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছে। শ্রমিকরা ক্রমাগত ভাবে বলে আসছে যে তাদের নিরাপদে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ বা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। গলিত স্টিলের মধ্যে কাটার সময়, বিষাক্ত ধোঁয়া শ্বাস না নেওয়ার জন্য তাদের শার্টগুলি তাদের মুখের চারপাশে মোড়ানো এবং খালি পায়ে ইস্পাতের টুকরো বহন করার জন্য তাদের হাত মোজা গুলিকে গ্লাভস হিসাবে ব্যবহার করার বর্ণনা দিয়েছেন।
শ্রমিকরা ইস্পাতের টুকরো পড়ে যাওয়া বা জাহাজে আগুন লেগে বা পাইপ বিস্ফোরণে আটকে পড়ার কারণে আহত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। শিপ ইয়ার্ডগুলিতে সহজলভ্য জরুরী চিকিৎসা পরিষেবার অভাবের অর্থ হল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, শ্রমিকদের তাদের আহত সহকর্মীদের সাগর পাড় থেকে রাস্তায় নিয়ে যেতে এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন প্রাইভেট গাড়ি খুঁজতে বাধ্য হতে হয়েছিল। বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে পুরুষদের আয়ু গড় আয়ুর চেয়ে ২০ বছর কম। একজন ৩১ বছর বয়সী কর্মী যেমনটি বলেছিলেন, "আমি যেখানে কাজ করি সেখানে যদি আমি এক মুহুর্তের জন্যও বিভ্রান্ত বা অন্যমনস্ক হয়ে যাই তবে আমি মুহুর্তের মধ্যেই মারা যেতে পারি।"
জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকদের ২০১৯ সালের একটি জরিপে বলে হয়েছে যে আনুমানিক ১৩ শতাংশ শ্রম শক্তিতে শিশুরা নিয়োজিত। তবে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, অবৈধ ভাবে রাতে নিয়োজিত কাজের শিফটের সময় এই সংখ্যা ২০ শতাংশে বেড়ে যায়। সাক্ষাৎকার নেওয়া অনেক কর্মী প্রায় ১৩ বছর বয়সে কাজ শুরু করেছিলেন।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকরা জানান, বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘন করে তাদের বিরতি বা অসুস্থজনিত, এমনকি চাকুরিরত অবস্থায় আহত হলেও প্রায়ই তাদের ছুটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি প্রবিধানের অধীনে আইনত যা পাওয়ার অধিকার রয়েছে তার একটি ভগ্নাংশ দেওয়া হয়। শ্রমিকদের খুব কমই প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, যার অর্থ হল ইয়ার্ড মালিকরা শ্রমিকের মৃত্যু এবং আঘাতকে আড়াল করে রাখতে পারে। শ্রমিকরা যখন ইউনিয়ন করার চেষ্টা করে বা দাবির প্রতিবাদ করে, তখন তাদের বরখাস্ত করা হয় এবং হয়রানি করা হয়।
বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডগুলিতে "বিচিং বা সৈকতায়ন" নামক একটি পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে যেখানে কোন ডক বা অন্তর্ভুক্ত প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার না করেই জাহাজগুলিকে উচ্চ জোয়ারের সময়কার সম্পূর্ণ বাতাসকে ব্যবহার করে সাগর পাড়ের বালির দিকে নিয়ে আসা যায়। যেহেতু কাজটি সরাসরি বালিতেই করা হয়, তাই কাজের পরিবেশটি নিজেই বিপদাপন্ন অবস্থায় থাকে এবং এই কাজে বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি বালি এবং সমুদ্রে ফেলা হয়। অ্যাসবেস্টস সহ জাহাজ থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ছাড়াই পরিচালনা করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে পুরাতন জিনিসপত্র কেনা-বেচার বাজারে বিক্রি করা হয়, যা আশে পাশের কমিউনিটির মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে আসছে।
আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক আইন বাংলাদেশের ইয়ার্ডের মতো জায়গায় জাহাজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে যেখানে পর্যাপ্ত পরিবেশ বা শ্রম সুরক্ষা নেই। তবুও অনেক শিপিং সংস্থাগুলি নিয়মগুলি পাশ কাটিয়ে যাওয়া এবং দোষ এড়ানোর উপায় খুব সহজেই খুঁজে পেয়েছে, জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা ব্যবহার করে যাত্রা করা জাহাজগুলিকে তাদের ইইউ-অনুমোদিত ফ্যাসিলিটিতেই জাহাজগুলোকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে হয়, যার কোনোটিই বাংলাদেশে নেই। কোম্পানিগুলি অন্য দেশের "সুবিধামত পতাকা" ব্যবহার করে নিয়মগুলোকে এড়িয়ে যায়।
সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করা পতাকাগুলি পতাকা রেজিস্ট্রিগুলির দ্বারা বিক্রি করা হয় যা অনেক ক্ষেত্রে, প্রাইভেট কোম্পানিগুলি তাদের নিজ দেশের পতাকা ব্যবহৃত থেকে ভিন্ন দেশে কাজ করে। ২০২২ সালে, যেখানে বিশ্বের মেয়াদ উত্তীর্ন জাহাজের ৩০ শতাংশেরও বেশি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মালিকানাধীন ছিল, সেখানে ভাঙ্গার উদ্দ্যেশে বিক্রয়কৃত ৫ শতাংশেরও কম জাহাজে ইইউ পতাকা ব্যবহার করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে তাদের জাহাজ ডাম্প করার আশায় শিপিং কোম্পানিগুলো সাধারণত নগদ ক্রেতা নামে একজন স্ক্র্যাপ ডিলারের কাছে তাদের জাহাজ বিক্রি করে দিয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে বিক্রয়ের সময় ক্রেতা একটি শেল কোম্পানি ব্যবহার করে, যার ফলে প্রকৃতপক্ষে এর আসল/সঠিক নিয়ন্ত্রণকারী এবং বিক্রয় থেকে লাভবান হওয়া প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক আইন এবং নিয়ন্ত্রক মান প্রয়োগের অভাবে বিপজ্জনক এবং পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকারক পরিস্থিতিতে জাহাজগুলিকে স্ক্র্যাপ করার পথকে সুগম করে দেয়। বাংলাদেশে ঘোষণাকৃত আমদানি করা জাহাজের বর্জ্য প্রায়শই কোনো তত্ত্বাবধান, স্বচ্ছতা বা স্পষ্ট স্বীকৃতি ছাড়াই সম্পন্ন হয়ে থাকে, যার ফলাফলে মারাত্মক পরিণতির সম্ভাবনা থেকে যায়। রপ্তানিকারক দেশগুলি আমদানিকারক দেশের কাছ থেকে পূর্ব অবহিত সম্মতি পাওয়ার জন্য বাসেল কনভেনশনের অধীনে প্রয়োজনীয়তাগুলিকে সরাসরি উপেক্ষা করে এবং মেয়াদ উত্তীর্ন জাহাজগুলি শুধুমাত্র বিষাক্ত বর্জ্যের পরিবেশগতভাবে টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা সম্পন্ন দেশগুলিতে পাঠানো হয়।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), শিপিং কোম্পানি এবং শিপব্রেকিং ইয়ার্ড একটি নিরাপদ এবং টেকসই জাহাজ পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের সমাধান হিসাবে হংকং কনভেনশনকে প্রচার করে, বিশেষজ্ঞরা এবং অ্যাক্টিভিস্টরা দীর্ঘকাল ধরে এই কনভেনশনের প্রধান ফাঁকফোঁকর গুলি নিয়ে আক্ষেপ জানিয়ে যাচ্ছেন যেগুলো পর্যাপ্ত মাত্রার নিয়ন্ত্রণ প্রদানের ক্ষমতাকে দুর্বল করে।
গ্রিন ওয়াশিং অনিরাপদ অনুশীলনে সময় এবং সংস্থান বিনিয়োগ করার পরিবর্তে, কোম্পানিগুলির জাহাজ রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রমাণিত নিরাপদ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা উচিত এবং তাদের সমুদ্রে জাহাজ বিচিং করা নিরাপদ বলে জোর দেওয়া বন্ধ করা উচিত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে।
পরবর্তী দশকে মেয়াদ উত্তীর্ন জাহাজগুলির ধারনাকৃত বিশাল প্রবাহকে নিরাপদে পুনর্ব্যবহার করার জন্য বিশ্বব্যাপী সক্ষমতা নিশ্চিত করতে, শিপিং কোম্পানিগুলিকে এমন একটি স্ট্যান্ডার্ডে স্থিতিশীল প্ল্যাটফর্ম সুবিধা তৈরিতে বিনিয়োগ করা উচিত যা শ্রমিকদের অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করে এবং ডাউনস্ট্রিম ম্যানেজমেন্ট এবং বর্জ্য নিষ্পত্তির ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম বলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত শিপিং কোম্পানিগুলোকে কার্যকরভাবে দায়বদ্ধ রাখতে এবং তাদের আইন লঙ্ঘন করা থেকে বিরত রাখতে শিপ রিসাইক্লিং রেগুলেশন সংশোধন করা।
"জোয়ারের মাটিতে জাহাজগুলিকে আলাদা করে ফেলা শ্রমিকদের মারাত্মক পরিণতি সহ অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকির মুখোমুখি করে এবং সংবেদনশীল উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়," বলেছেন এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের নির্বাহী পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা ইঙ্গভিল্ড জেনসেন। "টেকসই জাহাজ পুনর্ব্যবহারের খরচ অবশ্যই শিপিং সেক্টরকে বহন করতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ এবং পরিবেশ নয়।"
নির্বাচিত উদ্ধৃতি , বর্ণনাঃ
শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
“আমরা শিপইয়ার্ডে কাজ করার সময় নিরাপদ নই,” বলেছেন কামরুল, ৩৯, যিনি ১২ বছর বয়স থেকে জাহাজ ভাঙার কাজ করেছেন। “ধারালো ধাতব পদার্থ কিংবা আগুনের শিখা আমাদের আঘাত করে। অধিকাংশ শ্রমিকই কোনো না কোনো সময় দগ্ধ হয়ে যায়। আমি কখনই নিরাপদ বোধ করি না।"
“জাহাজটি বিশাল” ২৬ বছর বয়সী আহমেদ বলেন। “আমরা একটি দড়ির মই ব্যবহার করে পাশ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় জাহাজটি কেটে ফেলি। শ্রমিকরা মাঝে মাঝে পিছলে পানিতে পড়ে যায়।”
২৫ বছর বয়সী হাসান বলেছিলেন যে তিনি একটি জাহাজের দ্বিতীয় তলা থেকে পড়ে যাওয়ার পরে তিনি ২০২১ সালের এপ্রিলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ছিলেন: "আমার কাছে কোনও সুরক্ষিত সরঞ্জাম ছিল না, তাই আমি প্রায় ৪.৫ মিটার নিচে নিচ তলায় পড়ে গিয়েছিলাম।"
“আমি প্রতিদিন ২০০ টাকা আয় করি, তাই ৮০০ টাকা দামের গামবুট কেনার সামর্থ্য করতে পারছি না,” বললেন ২৭ বছর বয়সী সোহরাব। “আমি খালি পায়ে কাজ করি। এ কারণে শ্রমিকরা প্রায়ই আগুনের কারণে কিংবা আমাদের পায়ে তার বা পেরেকের আঘাতে আহত হয়ে থাকে। কোম্পানি আমাদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই প্রদান করে না। আমি নিরাপত্তার সরঞ্জাম চাইলে কোম্পানির মালিকরা বলে, ‘সমস্যা থাকলে চলে যান।‘”
২০১৭ সালের ১৯শে নভেম্বর, মধ্যরাতে একটি অবৈধ ভাবে নিয়োজিত নাইট শিফটে কাজের সময় ২০ বছর বয়সী রাকিব লোহার একটি ভারী টুকরো কাটার সময় সেটি পড়ে যাওয়ায় তার বাম পা কেটে যায়, তখন একটি লোহার রডও তার পেটে বিদ্ধ হয়। অন্য কর্মীরা তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হওয়ার আগে তাকে ৪৫ মিনিটের মত মাটিতে পড়ে থাকতে হয়েছিল। মাঝরাতে তাকে কাজে নিয়োজিত থাকার কারনে, সাথে সাথে কোনও গাড়ি বা রিকশা পাওয়া যায়নি, তাই তার সহকর্মীদের তাকে তাদের কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। রাকিব বলেন, ইয়ার্ডের মালিকরা শুধুমাত্র জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার জন্য অর্থ দিতে ইচ্ছুক, এবং তাই ১৭ দিন পর তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে ছিল, এবং পরিবারকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবার জন্য ঋণ নিতে হয়েছিল। রাকিব বলেন, শিপইয়ার্ড মালিকরা কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিল। “আমার বয়স মাত্র ২০ বছর এবং এই দুর্ঘটনায় আমার জীবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে,” জানায় রাকিব।
২০১৯ সালের ১৯শে জুন, ২৮ বছর বয়সী সাকাওয়াত তার কাঁধে একটি লোহার বান্ডিল নিয়ে যাওয়ার সময় সে পিছলে যায় এবং বান্ডিলটি পড়ে যায়, এতে করে তার ডান পা ভেঙে যায়। তিনি একটি হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানে শেষ পর্যন্ত তার পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। ইয়ার্ডের মালিকরা তার চিকিৎসার খরচ বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং তাই তিনি তার চিকিৎসার জন্য পুরো সঞ্চয় খরচ করে ফেলেন এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নেন। সে এখন গৃহহীন এবং রেলওয়ে স্টেশনে ঘুমান যেখানে সে ভিক্ষা করে বেঁচে আছেন।
শ্রমিকরা যখন শ্বাসযন্ত্র এবং অন্যান্য প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ছাড়াই জাহাজের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তখন অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ তাদের নিঃশ্বাসের সাথে ভিতরে চলে যায়। ৫০ বছর বয়সী তানভীর, যিনি কাটার হিসেবে কাজ করেন, তিনি বলেন, “আমরা যখন কাটিং করি, তখন এসকল ধোঁয়া আমাদের বিভিন্ন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা যেমন কাশি এবং শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের কোনো শ্বাসযন্ত্র সরবরাহ করা হয় না, তাই আমরা আমাদের নিজস্ব কাপড় মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করি কিন্তু তারপরও ধোঁয়া ভিতরে চলে যায়।“
শ্রমিকরা বলেছেন যে ৮-১২ ঘন্টা শিফটে প্রতি সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করা সত্ত্বেও তাদের খুব কমই বিরতি বা নিরাপদে বিশ্রামের জন্য জায়গা দেওয়া হয়। ২৮ বছর বয়সী আরিফুল বলেছেন যে তাদের বিশ্রামের জন্য তিরস্কার করা হয়, "যদি ফোরম্যান বা ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ আমাদের বসে বা বিশ্রাম নিতে দেখেন, তারা তিরস্কার করেন," তিনি বলেছিলেন।
"শ্রমিকদের কোন লিখিত চুক্তি নেই," রাশেদ, একজন শ্রমিক এবং শ্রম অধিকার কর্মী জানিয়েছেন। “এর মানে নিয়োগকর্তারা মজুরি দিতে অস্বীকার করতে পারেন। নিয়োগকর্তারা সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি দেন না। মালিকরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থ প্রদান করে থাকে।"
“কিছু কোম্পানি কর্মীদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয় শুধুমাত্র অফিসিয়াল উদ্দেশ্যে,” ২৭ বছর বয়সী অশোক বলেছেন। “কিন্তু আসলেই এই 'চুক্তিগুলো' শ্রমিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয় না। কখনও কখনও আমরা একটি চুক্তির কাগজে স্বাক্ষর করি আবার কখনও কখনও কেবল কোন সাদা কাগজেও স্বাক্ষর করে থাকি।“
“আমাদের কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন নেই যা আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে,” ২২ বছর বয়সী সৈয়দ বলেন। “কেউ আমাদের পক্ষে বা আমাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে না।” ৩৯ বছর বয়সী কামরুল বলেন, “শ্রমিকরা আওয়াজ তুললে চাকরি হারাবে।“ ২৬ বছর বয়সী আহমেদ বলেছেন:
"যদি কোম্পানি জানতে পারে যে আমি আপনার সাথে কথা বলেছি, তাহলে আমি প্রতিশোধের সম্মুখীন হব এবং এর ফলে আমার চাকরি হারাতে হতে পারে," ২৬ বছর বয়সী আহমেদ বলেন। "কিন্তু আমি আপনাকে যা বলছি তা সত্য। আমি জানি না জাহাজ ভাঙ্গা ইয়ার্ড কোম্পানিগুলো কখনো আমাদের মানুষ হিসেবে ভাববে কিনা এবং নিরাপত্তার সরঞ্জাম দেবে কি না।”
“ইয়ার্ডের ভেতরে বা বাইরে জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের জীবন সবসময়ই কোম্পানির মালিকদের চাপে লুকিয়ে থাকে।“ ২৮ বছর বয়সী সোহেল বলেছেন। “আমরা কথা বললে বা আওয়াজ তুললে, আমরা আমাদের চাকরি হারাবো।”
৪৫ বছর বয়সী অশোক, যিনি ১০ বছর বয়স থেকে জাহাজ ভাঙ্গার কাজ করে আসছেন, বলেছেন যে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শিপইয়ার্ডের মালিকরা বর্জ্য রাখার জন্য কিছু স্টোরেজ রুম তৈরি করেছিলেন, কিন্তু "তারা সেই বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে।" ২৫ বছর বয়সী আইজাজ বলেছিলেন যে তিনি একজন জেলে ছিলেন কিন্তু তিনি তার জীবিকা হারিয়ে ফেলার কারনে জাহাজ ভাঙার কাজ শুরু করেছিলেন, তিনি বলেনঃ “জাহাজ জল দূষিত হয় যখন তারা পানিতে জ্বালানী এবং রাসায়নিক পদার্থ ফেলে দেয় যা সমুদ্রের গাছপালা এবং মাছের জন্য ক্ষতিকারক। . জেলেরা আর আগের মতো মাছ পাচ্ছেন না। এখানকার উপকূলীয় এলাকায় মাছের অভাব রয়েছে।”
“জাহাজের কারনে সমুদ্রের পানি দূষিত হচ্ছে এবং সমুদ্রের পানিতে তা বিষাক্ত রূপ ধারণ করছে, তাই জেলেরা কোনো মাছ খুঁজে পাচ্ছেন না,” শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে আহত হওয়ার পর মাছ বিক্রি শুরু করা ৪৪ বছর বয়সী মাসুম বলেন, “মাছ এখন মরে যাচ্ছে।“